ফিচারবিবিধ

কেন পাস করতে পারছে না লাখো শিক্ষার্থী, তদন্তের তাগিদ

২০২৪ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় সারা দেশের ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হলেও অনুত্তীর্ণ থাকে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৭ জন। প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর জিপিএ-৫, পাসের হার কিংবা কোন শিক্ষা বোর্ড ভালো করেছে বা মন্দ করেছে তা নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু ফের করার কারণ নিয়ে সেরকম আলোচনা হয় না। এ বিষয়ে জোর দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা ও সংশ্লিষ্টরা।

মঙ্গলবার (১১ জুন) শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, সংস্কৃতিজন, শিক্ষক, অভিভাবক ও অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যতিক্রমি আয়োজন করেছে গণসাক্ষরতা অভিযান। এসএসসি পরীক্ষা অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ‘চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী সম্মেলন’ অনুষ্ঠানটি হয়েছে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে।

অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলেন,  কথিক ‘অকৃতকার্য’ এই শিক্ষার্থীদের জীবনের গল্প থেকে যায় সামাজিক দায়িত্ববোধের হিসাবের বাইরে। এসব শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা নিয়ে কোনও আলোচনা হয় না। অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে গ্লানি ঘোচাতে। এসব শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য বলা যাবে না। তারা কেন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারেনি তার কারণ খুঁজে বের করে হিসাবের খাতায় আনতে হবে। সহযোগিতা করতে হবে, সামজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।

দিনব্যাপী ‘চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী সম্মেলন’ অনুষ্ঠানে সকালের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপার্সন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদ, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ড. জাফর ইকবাল, বিশিষ্ট সংস্কৃতিজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক, সাবেক সচিব এন আই খান, যুব উন্নয়ন অধিদফতরের পরিচালক (বাস্তবায়ন, মনিটরিং ও যুবসংগঠন)।

সকালের অধিবেশনে বক্তব্য শেষে বাঁশি বাজিয়ে এবং সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শিক্ষাথীদের অনুপ্রাণিত করেছেন সংগীত শিল্পী রাহুল আনন্দ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নিবার্হী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ও সহ-সঞ্চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চ্যানেল আইয়ের বিশেষ প্রতিনিধি মোস্তফা মল্লিক।

অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেন, বুঝে পড়তে হবে, চিন্তা করতে হবে এবং প্রশ্ন করতে হবে। তাহলে ফেল করার কোনও প্রশ্নই নেই। সরকারের তদারকি করার কথা। উপজেলার শিক্ষা অফিসাররা তদারকি করবেন, কিন্তু করেন না, করতে পারেন না। হয়ত একটা দুটোতে যান।

নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, তিন লাখের বেশি ছেলেমেয়েরা ফেল করেছে, ৫১টি প্রতিষ্ঠানের একজনও পাস করেনি। ভালো মতো তদন্ত করে দেখতে হবে কেন আমাদের ছেলেমেয়েরা পাস করেনি। কার দোষ খুঁজে বের করতে হবে।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ড. জাফর ইকবাল বলেন, আমাদের দেশের লেখাপড়ার মধ্যে সমস্যা কী আমি খুবই ভালো করে জানি। অনেকে হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা দিয়েছে, তার পরীক্ষা ভালো হবে কী করে? জীবনের ৫ শতাংশ হচ্ছে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, আর বাকি ৯৫ শতাংশ রয়ে গেছে। তাই এসব বাচ্চারা যাতে আবার পরীক্ষায় দেয় এবং উত্তীর্ণ হয়।

সংস্কৃতিজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, যারা উত্তীর্ণ হতে পারেনি তাদের জন্য কাউন্সিলিং জরুরি। শিক্ষার্থীদের শাসন নয়, তাদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে অভিভাবকদের-শিক্ষকদের।

মধ্যাহ্ণভোজের পর দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, সংসদ সদস্য আরমা দত্ত।

বক্তব্য শেষে শিক্ষার্থীদের এভারেস্ট বিজয়ের সাফল্য ও ব্যর্থতার গল্প শোনান এভারেস্ট বিজয়ী এম এ মুহিত এবং অনুপ্রেরণাদায়ক সংগীত পরিবেশন করেন জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী নকীব খান ও ফাহমিদা নবী। দ্বিতীয় অধিবেশনে সহ-সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন বিশিষ্ট উপস্থাপিকা শাকিলা মতিন মৃদুলা।

সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বিভিন্ন চাপে যদি অকৃতকার্য হয় তাহলে তাদের দোষ নয়। তাদের আমাদের দায় রয়েছে। সম্পূর্ণ ফেল বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। শিক্ষার্থীরা নিজের কোনও ব্যার্থতায় অকৃতকার্য হয়নি। তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।   

সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, আমি অংকে পরীক্ষায় শূন্য পেয়েছিলাম। তোমরা যারা অকৃতকার্যয তাদের মন খারাপ করার কোনও কারণ নেই। শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ, শিখ্ষক ও অভিভাবকরা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার বিষয় তুলে ধরেন। অকৃতকার্যয শিক্ষার্থীরা তাদের অকৃতকার্য হওয়ার কারণ তুলে ধরেন। শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ শুনে শিক্ষাবিদরা এর উত্তোরণে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের আরও যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানান। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে বলেন। বিভিন্ন সুপারিশ উঠে আসে অনুষ্ঠানে। 

অনুষ্ঠানে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, হিসাবের খাতা থেকে যেন এসব শিক্ষার্থীরা বাদ না যায়। উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়েনি। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।

তিনি আরও বলেন, শুধু শিক্ষার্থীর জন্য নয়, শিক্ষকদের জন্য কাউন্সিলিং প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অনুত্তীর্ণদের সহায়তা করা প্রয়োজন। সাড়ে ৩ লাখের বেশি শেক্ষার্থীর জন্য সুযোগ তৈরি করাটা জরুরি।

সম্মেলনে সারা দেশ থেকে ৪২টি জেলা থেকে ৫ শতাধিক শিক্ষাথী, অভিভাবক, শিক্ষক ও এনজিও কর্মী অংশ নেন।

সম্মেলনে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নতুনহাট শফিউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাথী শিপ্রা রানী সম্মেলনের প্রস্তাবিত সুপারিশ উপস্থাপন করে।

সুপারিশের মধ্যে রয়েছে—

১) পরীক্ষার আগে প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা কার্যক্রমে সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

২) ফলাফল প্রকাশের পরপরই অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্যালয়ভিত্তিক অনুপ্রেরণামূলক কাউন্সেলিং সভা আয়োজন করা।

৩) অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা/প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরিবেশ সুযোগ সৃষ্টি করা।

৪) শিক্ষাব্যয় কমিয়ে এনে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা চালু ও শিক্ষায় সাম্য প্রতিষ্ঠা করা।

৫) বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষক সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা। কোনও পদ খালি না রাখা। এজন্য নিয়োগযোগ্য শিক্ষকদের তালিকা প্রস্তুত করা।

৬) এনটিআরসিএ-এর শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান/তরান্বিত করা। সব শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করা।

৭) মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা।

৮) ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী/আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করা।

৯) শতভাগ শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা। ন্যূনতম ৫০০ টাকা পর্যায়ক্রমে ১০০০ টাকা করা।

১০) সব বিদ্যালয়ে মিড-ডে মিল ব্যবস্থা চালু করা। এক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি বেশি মনোযোগ ও গুরুত্ব দেওয়া।

১১) সব বিদ্যালয়ে সরকারিভাবে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা।

১২) বিদ্যালয় মনিটরিং শক্তিশালী করা।

১৩) বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নতুনত্ব আনা ও শক্তিশালী করা।

১৪) অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন ট্রেডভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের আওতায় আনা। তাদের আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্সিং কার্যক্রমের আওতায় আনা।

১৫) অকৃতকার্যরা যাতে ঝরে না পড়ে বিশেষ করে শিশুশ্রম এবং বাল্যবিবাহ রোধে অভিভাবকদের সচেতন করা।

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button